নকল হইতে সাবধান! (পর্ব-২)

'নকল’ একটি আরবি শব্দ যেন সে বাংলারই জাতভাই।

আমি কোনো বিশিষ্ট লেখক নই, শুধু মাঝেমধ্যে ছেলের জন্য চিৎকার করি, সেটা সাহিত্য হয় কি-না জানি না কিন্তু শোকগাঁথা হয়, দুঃখকথা হয় তা বুঝা যায় পাঠকদের প্রতিক্রিয়া পড়ে। তবে সেই অন্তর্বেদনাটা হয় আমার মতো করে, ব্যক্তিগত অভিব্যক্তিতে। সেই আর্তনাদে বের হয়ে আসে আমার নিজস্ব জীবনবোধ, আত্মোপলব্ধি, আত্মপরিচয়। সুতরাং পুরোটাই হয় একান্ত নিজস্ব ও মৌলিক, সর্বদা। অথচ তা-ও দেখি নকল হয়। আমি যেহেতু বিখ্যাত কেউ নই, সুতরাং নকুলেরা মনে করে আমার কথামালা নির্দ্বিধায় নির্ভয়ে নকল করা নিরাপদ।
মন একটু খারাপ হয় বটে, তবে ভাবি, কেন মানুষ অন্যের পালকে নিজে উড়তে চায়? ধার করা পোশাক খসে খুলে গেলে নিজের অন্তরঙ্গ যে বের হয়ে পড়বে, বেমালুম ভুলে যায় তারা। জানি অবশ্য, ডিজিটাল যুগে কপিরাইটের বালাই নেই। যে যেভাবে পারে অন্যেরটা নির্দ্বিধায় লুফে খেয়ে নেয়–যেন তার অধিকার। প্রথমদিকে মনে করেছি আমাকে ভালোবেসে নকল করে। পরে ভেবেছি বোকামি করেছে। এখন দেখি, না, তারা তো চতুর ঘুঘু। প্লেজারিজমের কত উদাহরণ আছে বিদ্যার সাগরে। সুতরাং এটি আর গালমন্দের জিনিসও নয়। তবে রয়েসয়ে করতে পারলেই লেঠা চুকে যায়। কীভাবে নকলের কাজটা সারে?
সরাসরি: জাস্ট কপি। লেখকের নামটার স্থলে উনার নামটা বসিয়ে দেন সযত্নে স্বাচ্ছন্দ্যে। মুচকি হেসে ভাবেন, আহা, লেখালেখি কি সহজ, বোকারা যদি তা বুঝতে পারত! পরিযোজন: ভেতরে লেখকের ব্যক্তিগত কথা থাকলে সেসব উঠিয়ে নিজের কিছু কথা যুক্ত করেন। কাটাছেঁড়া: অন্যের লেখার কসমেটিক সার্জারি করেন। ডানবাম করে একটা কিছু দাঁড় করান যেন মূল লেখক ধরলেও এড়িয়ে যেতে পারেন। ভাবসাব: কী-ওয়ার্ড বা মূলকথা নেন। ভাব বা মূলবক্তব্য নেন যেন মূললেখক বুঝতে না পারে সহজে। রূপকার: রূপ নেন, স্টাইল নেন, ধরন কারণ নেন। এরা আরও বুদ্ধিমান গোছের। ভাবেন, আমাকে এবার ধরে কে?
পরীক্ষায় বসে নকল লেখা এককালে ছিল লজ্জা অপমানের বিষয়, এখন হয়তো বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। ইদানীং তো ‘ওপেন-বুক’ সিস্টেমে বই দেখে পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর লেখার বিধানই চালু হয়েছে। নকলে তো তাও কিছু একটা করতে হয়, চুরিতে তো কিছুই করতে হয় না, জাস্ট দখলে নিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দিলেই হলো। চুরি করে হজম করে ফেলতে পারলে তো রাজা। ইউরোপের বড় সব জাদুঘরে এশিয়া-আফ্রিকার প্রাচীন ঐতিহ্যে ভরপুর, তারা কি তা প্রদর্শনে লজ্জা পায়? তবে নকল যত না দোষের, তার চেয়ে বেশি দোষের কৃতিত্বের বড়াই করায়। আসলের চেয়ে নকলের দাপট বেশি বলেই লোকে বলে ‘চোরের মার বড় গলা’ এবং ‘চুরি চুরি সিনাজুরি’।
যদিও নকলের প্রতি উন্নাসিক ভাব আছে সবার, জীবন একটা নিরন্তর নকলকরণ প্রক্রিয়া, তাকে ছাড়া জীবন জীবিকা অচল।
চলবে-

মনিরুল ইসলাম

রাষ্ট্রদূত- মিশর।

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button