ইসলামে জননিরাপত্তা (পর্ব-২)
আল্লাহর ভয় যা মানুষকে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত করতে সক্ষম
ইসলাম মানুষের জীবন, সম্পদ ও মান-ইজ্জতকে অত্যন্ত সম্মানীয় বলে ঘোষণা করেছে। কঠোর আইন-শৃঙ্খলার পাশাপাশি মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য পরকালে বিশ্বাসের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছে। সমাজে মানুষের শান্তি- স্বস্তি ব্যহত হয় এমন সকল কর্মকাণ্ডকে হারাম এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। মানুষের মধ্যে আল্লাহর স্মরণ ও ভয় সর্বক্ষণ জারি রাখার জন্য নামাজ-রোজার মতো ইবাদতকে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক (ফরজ) করেছে এবং রাষ্ট্র শক্তিপ্রয়োগ করে তা কার্যকর করবে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যক্তিও পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা নিয়ে জীবন পরিচালনার শিক্ষা আমরা আমাদের প্রিয়তম নবির কাছ থেকে পেয়েছি। তিনি বলেছেন- ‘যারা বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করে না, তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়’। অর্থাৎ তারা আর মুসলিম নন। তিনি আরো বলেন- ‘জমিনে যারা আছে তাদের সাথে সদাচরণ করো, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও তোমাদের সাথে সদাচরণ করবেন’।
আল্লাহর বাণী- ‘নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা -সামনি গালাগাল করে ও পেছনে দোষ প্রচার করে’। জননিরাপত্তা ব্যহত হয় বা মানুষের চলাফেরা, ঘরে অবস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য বা কোনো কাজে-কর্মে শান্তি ব্যহত হয় এরূপ কোনো কাজ বা আচরণ পরকালে জবাবদিহির অনুভূতি রয়েছে এমন মানুষের পক্ষে অসম্ভব। রসুল সা.-এর বাণী অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে- ‘ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয়, মু’মিন নয়, মু’মিন নয় যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়’।
আজকাল শাস্তিদানের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য উদ্বুদ্ধকরণ (Motivation) কর্মসূচি গ্রহণের উপর জোর তাগিদ প্রদান করা হচ্ছে। দুর্নীতি ও মাদককে না বলুন, ধুমপানে বিষপান, সন্ত্রাসকে ঘৃণা করুন ইত্যাদি শ্লোগানসম্বলিত পোস্টার, ব্যানার, মাথায় ক্যাপসহ বর্ণাঢ্য র্যালি প্রায়ই দৃষ্টিগোচর হয় এবং এসব করা হয় জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে। দুর্ভাগ্য, সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের প্রয়াসের মধ্যেও রয়েছে দুর্নীতি। কারণ এসব প্রচারণায় আল্লাহর ভয় জাগ্রত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই দুর্নীতিবিরোধী এসব প্রচার-প্রচারণায় ত্রিশ হাজার টাকা খরচে তিন লক্ষ টাকায় বিল- ভাউচার করতে আমাদের আত্মা কাঁপে না। এই Motivation বা উদ্বুদ্ধকরণ ইসলামের ভিত্তিতে হলে মানুষের মধ্যে জাগ্রত হতো আল্লাহর ভয় যা মানুষকে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হতো।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের বাড়ি অত্যন্ত নিরাপদ। কোনো বাড়িতে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ বা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করা জঘন্য অপরাধ। এমতাবস্থা চোখ ফুটো করে দেয়ার কথা হাদিসে বলা হয়েছে। একজন মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে (প্রাইভেসিকে) ইসলাম অত্যন্ত মূল্য প্রদান করে। তাই দু’জন মানুষ কথা বললে সেখানে তৃতীয় জনের এগিয়ে যাওয়া, কারো চিঠি পড়া, মোবাইলে আড়ি পেতে কিছু শোনা সবই ইসলামে নিষিদ্ধ। দুর্ভাগ্য, আজ আমাদের বাড়ি, মেস, উপাশনালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই। চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী তো বটেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও গভীর রাতে মানুষের বাসাবাড়ি বা মেসে হানা দেয়। প্রয়োজন ছিল কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে প্রথমে তাকে তলব করা এবং উপস্থিত না হলে ফেরারি ঘোষণা করা।
এ প্রসঙ্গে খলিফাতুল মুসলেমিন হযরত উমর ফারুক রা. -এর একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। তিনি তাঁর নাগরিকদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য রাতে ঘুরে বেড়াতেন। এমনি একদিন চলার পথে একটি বাড়ি থেকে গানের আওয়াজ তাঁর কানে আসে। তিনি দেওয়ালের উপরে উঠে দেখেন যে, এক লোকের সামনে শূরা ও মেয়ে মানুষ। তিনি তা দেখে বলেন-‘হে আল্লাহর দুশমন! তুই কি মনে করেছিস যে গোপনে পাপ করবি আর আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিবেন না’? লোকটি জবাবে বলে-‘হে আমিরুল মু’মেনিন! তাড়াহুড়া করবেন না। আমি অপরাধ একটি করলে আপনি করেছেন তিনটি। আল্লাহ তায়ালা গোপন বিষয়ে খোঁজা-খুঁজি করতে নিষেধ করেছেন, আর আপনি তাই করলেন; আল্লাহ সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে বলেছেন, আর আপনি দেয়ালের উপরে উঠে পড়েছেন; আল্লাহ অনুমতি নিয়ে ও সালাম বিনিময় করে কারো ঘরে প্রবেশ করতে বলেছেন, আর আপনি অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করেছেন’। উমর রা. ভুল স্বীকার করে ফিরে আসেন। অবশ্য তার কাছ থেকে ভালো হয়ে চলার প্রতিশ্রুতি আদায় করেন।