সুন্নাতি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (শেষ পর্ব)
অধ্যাপক আবু জাফর
- (লেখকের ‘ইসলাম ও আত্মঘাতী মুসলমান’ বই থেকে গৃহিত।)
প্রকৃতপক্ষে সুন্নাতি রসুলুল্লাহর অর্থ হলো, রসুল সা. এর আনীত পয়গাম এবং বিশ্বব্যাপী মানবসম্প্রদায়ের জন্য প্রদত্ত সর্বকল্যাণময় আদর্শের উত্তরাধিকার।
যেহেতু মুসলমানই এই মহৎ উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে, মুসলমানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, বিশ্বকে ইসলামের নির্ভুল ব্যবস্থাধীনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা ও ক্ষতিগ্রস্ত মানবসমাজের কাছে পৃথিবী-পরিচালনায় কুরআনের সংবিধানকে একমাত্র আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। এই কাজে গাফেল থেকে মুসলমান অন্যসব সুন্নাতকে যতই কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরুক, তা খুব-একটা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। ভুল হলে আল্লাহপাক মাফ করুন।
কুরআন, হাদিস, আসহাবে রসুল সা.-এর জীবনী ও ইসলামের ইতিহাসপাঠে আমার যেটুকু ধারণা হয়েছে তা হলো, সঠিক ইমান না থাকলে আল্লাহর কাছে সহস্র রকমের সৎকর্মের যেমন এক পয়সা মূল্য নেই, ঠিক একই রকম, রসুল সা.- আনীত মূল পয়গামের প্রতি অমনস্ক বা অন্যমনস্ক থেকে অন্য সকল সুন্নাত আঁকড়ে ধরার মধ্যে আদৌ কোনো সার্থকতা নেই। ইমানরিক্ত সৎকর্মের মতই তা গুরুত্বহীন।
রসুল সা. চেয়েছিলেন আল্লাহর পথনির্দেশনার আলোকে এমন একদল মানুষ তৈরী করতে, যারা হবে নির্লোভ, নির্ভীক, আল্লাহ এবং আল্লাহর দ্বীনের জন্য সর্বস্ব উৎসর্গিতপ্রাণ, যারা হবে ইবলিসের জন্য অসহ্যরূপে ভীতিকর, সমাজ ও পৃথিবী- পরিচালনায় যারা হবে আল্লাহপাকের একান্ত অনুগত, সত্য ইনসাফ ও সাহসিকতায় বলীয়ান দৃঢ়চিত্ত মুজাহিদ। সুন্নাতি রসুলুল্লাহ মানে, যতটুকু বুঝি, ইসলামের এই অকুতোভ মুজাহিদ হয়ে-ওঠারই অব্যর্থ সবক এবং রসুল সা.-এর জীবন ও জীবনাদর্শ দেখে-বুঝে হাতে-কলমে অনুশীলন।
অথচ কী বিস্ময়কর, মুসলমানের অবস্থাদৃষ্টে আজ আর মনেই হয় না, সে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব আল্লাহ’র প্রিয়তম নবি সা.-এর প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারপুষ্ট। তার সর্বাঙ্গে এখন শুধু জিল্লতি ও যন্ত্রণার কলঙ্কচিহ্ন। তাকে আর এখন শার্দূল বলা চলে না, সে এখন কাফের-মুশরিকদের পোষমানা সার্কাসের বাঘ। যাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহপাক ঘোষনা করেছেন, ‘ওয়া ছাখ্খারা লাকুম মাফিছ ছামাওয়াতি ওয়া মাফিল আরদি জামিয়াম মিনহু’ ভূমি থেকে নভোমণ্ডল পর্যন্ত সবকিছু তোমাদের অধীন করে দেয়া হয়েছে (সুরা জাসিয়া); সেই মুসলমান আজ সবকিছু থেকেও নিঃসম্বল, সর্বস্বান্ত ।
রসুল সা. বলেছেন, তোমরা যদি কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে থাকো, তোমাদের ভয় নেই, চিরদিন তোমরাই বিজয়ী থাকবে। আফসোস, আমরা আজ কী-যে সুন্নাহ আঁকড়ে ধরেছি, বিজয়ী থাকা তো দূরের কথা, আজ আমরা ভয়ার্ত মূষিকের মতো বিবরবাসী, কাফের-মুশরিক-মুনাফিক-পৌত্তলিকদের অঙ্গুলিচালিত করুণ ক্রীড়ানক। বিপদ বঞ্চনা জিল্লতি এসব কোনো কিছুই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আসে না; অতএব মুসলমান আজ বিপদের যোগ্য বলেই বিপদগ্রস্ত। এই জিল্লতি মুসলমানের দুই হাতে উপার্জিত জিল্লতি।
হৃদয় তবু হাহাকার করে ওঠে, মুসলমান কি তার হারানো গৌরব, নেতৃত্বের আসন আর কখনো ফিরে পাবে না? মুসলিম মিল্লাতের এই দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় কি অবশিষ্ট নেই? আছে। অবশ্যই আছে। কিন্তু তার আগে রসুল সা.-এর প্রতি মুহব্বতের নামে হামামী তামাশা পরিত্যাগ করতে হবে, চোখের জলে বুক-ভাসানো দোয়ার মাহফিল করে পৃথিবী-জয়ের দিবাস্বপ্ন ত্যাগ করতে হবে; পূর্ণ আনুগত্য ও আন্তরিকতা নিয়ে ফিরে আসতে হবে রসুল সা.-এর কাছে।
তিনি যে-সততা, ইনসাফ ও হিম্মতের পাঠ দান করেছিলেন, জাগিয়ে তুলেছিলেন আল্লাহ্’র পথে শাহাদাত-বরণের যে-অকুণ্ঠ তামান্না, মুসলমানকে আজ সেই-সুন্নাতের অনুগামী হতে হবে। মুসলিম উম্মাহ হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের এই একটি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।
আল্লাহপাক স্বীয় অনুগ্রহে আত্মভ্রষ্ট মুসলিম উম্মাহকে আল কুরআন ও সুন্নাতি রসুলুল্লাহ সম্পর্কে সঠিক ইলম ও সঠিক আমল দান করুন। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লাহ বিল্লাহ।
(সমাপ্ত)