মিশরের জাতীয় সংস্কৃতিতে রমজান রজনী
আল কোরআন নাজিল হয়েছে হিজাজে আর উত্তমরূপে তেলাওয়াত হয়েছে মিশরে
পিরামিড, নীল-নদ ও তুর পাহাড়ের দেশ মিশর। হাজার হাজার বছরের স্মৃতি বুকে জড়িয়ে আছে এই দেশ। ফেরাউনদের দেশ যেমন মিশর ঠিক তেমনী অসংখ্য নবী-রাসুল সাহাবা আউলিয়াদের দেশও মিশর।
পবিত্র কোরআনে ‘মিশর’ শব্দটি পাঁচবার উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা অনেক নেয়ামত-অনুকম্পায় মিশরীয়দের সিক্ত করেছেন। নীল নদের পানির বরকতে মিশরের জমিন থাকে সব সময় উর্বর। তাই মিশরকে নীল নদীর দান বলা হয়।
প্রাচীন কৃষ্টি সভ্যতা সমৃদ্ধ দেশটিতে রোজা শুরু হয় বেশ ধূমধাম করেই। সেখানে প্রতিটি বাড়ি, রাস্তা, দোকানে ফানুস জ্বালানো রমজানের সংস্কৃতি। দুপুরের পরই অলিগলিতে বসে ইফতারির জন্য ‘মায়েদাতুর রাহমান’ টেবিল। কোথাও ব্যক্তিগত উদ্যোগে, কোথাও আবার কোনো সেবামূলক সংস্থার অধীনে রাস্তায় সামীয়ানা টানিয়ে ‘মায়েদাতুর রাহমান’ নামক ইফতারীর আয়োজন করা হয়। ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, মুসলিম-খ্রিষ্টান প্রত্যেকেই অংশ গ্রহণ করেন এই ‘মায়েদাতুর রাহমান’ ইফতার টেবিলে।
ফেরাউনের স্মৃতি বিজড়িত মিশরে কামানের গোলার শব্দে শুরু করা হয় ইফতার। এটা বহুকাল ধরে চলে আসা তাদের একটি সামাজিক প্রচলন। সেই ৮৫৯ হিজরিতে ইখশিদি আমল থেকে চালু হয় এই নিয়ম। কিংবদন্তি আছে, কামানের গোলা ছোড়ার মাধ্যমে ইফতারের সময় ঘোষণার ঐহিত্য ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়। যখন ঘড়ি বা অন্যান্য প্রযুক্তি ছিল না, তখন মানুষকে ইফতারের সময়ের জানান দিতে এটাই ছিল একমাত্র পন্থা।
সাধারণত পানি ও খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙা হলেও ফলের রস, কোষাব পান করার মাধ্যমে ইফতার শুরু করেন মিশরীয়রা। প্রধান ইফতার আইটেমে থাকে মা’হসী محشى, (rice stuffed vegetable) মলোখইয়া ملوخية, (পাট শাকের সোপ) বামিয়া মা’আ লাহমা بامية باللحمة, (মাংশ ও ডেঢ়শ ভোনা) ফেরাখ মা’হামমারা فراخ محمرة, ( Grilled or roasted Chicken) এইশ বেলাদী عيش بلدى, ( মিশরীয় আটার রুটি) তাজা ফল ও পুদিনা দিয়ে চা ইত্যাদি।
ইফতারের পর থেকে সেহরি পর্যন্ত পুরো সময়টাই সবজায়গায় থাকে ইবাদত করার মনোরম পরিবেশ। মাগরিবের কিছুক্ষণ পর থেকেই মানুষ ছুটে যায় তারাবির নামাজ জামাতে আদায় করতে। প্রতিরাতে ইমামগণ তারাবিতে এক বা অধিক পারা তেলাওয়াত করেন। কোনো কোনো মসজিদ তিন-চার পারাও তেলাওয়াত করা হয়। বিভিন্ন কেরাতে (তেলাওয়াত-শৈলী) ইমামরা নামাজ পড়ান।
তারাবির নামাজের মধ্যেভাগে থাকে সংক্ষিপ্ত বিরতি ও আলোচনা। এ সময় প্রতিটি মসজিদেই দেখা যায় ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের বাড়ি থেকে (মায়েদের দেওয়া) আনা মিষ্টি, খেজুর ফলের জুস ও ঠান্ডা পানি দিয়ে মুসল্লিদের আপ্যায়ন করতে। তারাবি শেষে মুসাল্লিরা তাদের নিজ নিজ ঘরে ফেরেন। পনেরো রোজার পর থেকে তারাবির দুই-তিন ঘণ্টা বিশ্রামের পর তারা আবার ফিরে যান মাসজিদে; তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের জন্য। তারা জামাতবদ্ধ হয়ে তাহাজ্জুদ আদায় করেন এক বা দুই খতম কোরআন পড়ার মাধ্যমে।
পবিত্র রমজানে আরেকটি বিষয় যেটি মিশরে বেশী দৃশ্যমান হয়, তাহলো পবিত্র কোরআনের প্রতি তাদের যত্ন ও ভালোবাসা। বলা হয়, পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে হিজাজে। আর এ কোরআন উত্তমরূপে তেলাওয়াত হয়েছে মিশরে। পুরো রমজান জুড়ে সেখানে থাকে কোরআন চর্চার পরিবেশ। সবজায়গা থেকে শুনা যায় কোরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ।
বিশ্বের বড় বড় নন্দিত ক্বারিদের জন্ম মিশরে। উল্লেখ্য, ক্বারি আব্দুল বাসেত আব্দুস সামাদ, শাইখ মাহমুদ খলিল আল-হুসারি, শাইখ আস-সিদ্দিক আল-মিনশাওভি সহ আরো অনেক। সবজায়গা থেকে ভেসে আসে তাদের সুমিষ্ট কন্ঠে তেলাওয়াতের ধ্বনি। অভ্যাসগত ভাবেই মিশরীয়রা তেলাওয়াত করতে ও তেলাওয়াত শুনতে পছন্দ করে।
বলাবাহুল্য যে, মিশরের প্রায় মাসজিদেই থাকে মহিলাদের নামাজের ব্যাবস্থা। মাজহাব গত দিক থেকে মিশরের অধিকাংশ মানুষ শাফেয়ী মাযহাব অনুসরণ করেন। সর্বোপরি পুরো রমজানে তারা আমলের সঙ্গে কাটান।