লন্ডনের বুকে এক খন্ড বাংলাদেশ!
পার্কের ভেতর ঢুকলেই মনে হবে আপনি যেন হঠাৎ করে একখণ্ড বাংলাদেশে এসেছেন
যুক্তরাজ্যের চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে কন্যা জননীর ‘এমপিএইচ’ সমাপনী অনুষ্ঠান শেষ করে পর দিন গেলাম লন্ডনে। ঠিকানা- বন্ধুবর বাংলাদেশ হাইকমিশনারের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম এর বাসা। অনেক দিনের পুরানো বন্ধু, তাই অনেক পিড়াপিড়ি করেও হোটেলে উঠতে পারিনি।
৮০র দশকের মাঝামাঝি সময়ে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছি ঢাকাস্থ বৃটিশ হাই কমিশনে। তখন থেকেই লন্ডন শহর দেখার জন্য ছিল প্রচন্ড আগ্রহ। তাই কোন মত রাতটি কাটিয়ে পর দিন প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যেই বেরিয়ে পরলাম হোয়াইট চ্যাপেল এলাকার উদ্দেশ্যে।
সাইফুল ভাই এর বাসা থেকে ১০ মিনিট পায়ে হেটে পাতাল রেল (আন্ডার গ্রাউন্ড মেট্রো) স্টেশন। জিজ্ঞেস করল, বাসে যাবেন না পাতাল রেল? আমি বললাম, পাতাল রেল তো মাটির তলদেশ দিয়ে চলে। কিছু দেখতে পারব না, চলেন বাসে যাই। দোতলা বাসের ফাকা সিট পেয়ে একেবারে সামনের সারির আসনে বসলাম।
ঝির ঝির বৃষ্টির মধ্যেই বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা টাওয়ার হ্যামলেটে নেমে ব্রিকলেন রাস্তার দিকে হাটছিলাম। আশপাশ দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন কিশোরগঞ্জের কাচারী বাজার। খোলা আকাশের ফুটপাতে শাক সব্জি ফলমুল ও কাপড়ের পসরা সাজিয়ে বসছে লুঙ্গি পড়া সিলেটি দেশি ভাইয়েরা। সাইফুল ভাই জানালেন, এই এলাকায় রয়েছে এক বাঙালির অনন্যকীর্তি।
সেই কীর্তি দেখাতে এক পার্কে নিয়ে গেলেন তিনি। বৃষ্টির পানিতে পার্কের গাছগুলো যেন আরও সবুজ ও সতেজ হয়ে উঠেছে। নাকে লাগছে মাটির সোঁদা গন্ধ। চোখ আটকে গেল পার্কের নাম লেখা সাইনবোর্ডে। ইংরেজিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘আলতাব আলী পার্ক’।
আলতাব আলী লন্ডনের বাঙালি অভিবাসী ছিলেন। তিনি কারখানাশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। গত শতকের সত্তরের দশকে ব্রিটেনে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল। ১৯৭৮ সালের ৪ মে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে অজ্ঞাত কয়েকজন বর্ণবাদীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন তরুণ বাঙালি শ্রমিক আলতাব আলী।
বর্ণবাদী হামলায় আলতাব আলীর মৃত্যুতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে হাজারো মানুষ। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। মানুষ রাজপথে নেমে আসে। আলতাব আলীর মৃত্যু এই আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করে। ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে আলতাব আলীর নাম। এ জন্যই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৯৮ সালে পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে অবস্থিত সেন্ট মেরিস পার্ককে আলতাব আলী পার্ক নামকরণ করা হয়।
লন্ডনে আলতাব আলীর নামে পার্ক বিদেশের মাটিতে বাঙালিদের নতুন সম্মান এন দেয়। আলতাব আলী পার্কের ভেতর ঢুকলেই মনে হবে আপনি যেন হঠাৎ করে একখণ্ড বাংলাদেশে এসেছেন। পার্কের চারদিকে উঁচু উঁচু গাছ। মাঠ ভরা সবুজ ঘাস।
পার্কের ভেতরে রয়েছে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে একটা শহীদ মিনার। ১৯৯৯ সালে পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের দক্ষিণ অংশে নির্মাণ করা হয় এই শহীদ মিনার; যা দেশের বাইরে বানানো প্রথম শহীদ মিনার।