ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি বাঙালির অহংকার ও গর্বের মাস
ভাষার মাস শুরু হলো
আজ বাঙালির ভাষা রক্ষার স্মৃতিবাহী মাস ফেব্রুয়ারির শুরু। আজ গেয়ে ওঠার দিন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি। ’ অথবা মনে পড়বে সেই অমর কবিতা—‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। ’
আজ থেকে ৭০ বছর আগে ১৯৫২ সালের এ মাসেই প্রাণের ভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে গড়ে ওঠা দুর্বার আন্দোলনের পরিণতিতে অর্জিত হয় আজকের বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ড।
‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’—পাকিস্তান সরকারের এমন ঘোষণায় পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়। জাগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। পূর্ব বাংলার মানুষ অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। তাই বাংলা ভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই আদেশ অমান্য করে ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নিহত হন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত, রফিকসহ নাম না জানা আরো অনেকে। আন্দোলন ছড়িয়ে পদে সারা দেশে।
এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। সেই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরে ৯ মাসব্যাপী স্বাধীনতাযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দেওয়ার এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আর সেই বিরল আত্মদানের স্বীকৃতি হিসেবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে উদযাপন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ভাষার জন্য বাংলার দামাল সন্তানদের আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এদিন ইউনেসকো ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখন বিশ্বের দেশে দেশে পালন করা হয়।
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি বাঙালির অহংকার ও গর্বের মাস। এ মাস একুশের শহীদের স্মৃতিবাহী শোকাবহ মাস। আত্মত্যাগ ও আত্মজাগরণের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের কারণে মাসটিকে উদযাপন করা হয় পরম মমতায়। কিন্তু গত বছরের মতো এবারও বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে অন্যান্য অনেক কিছুর মতোই ফেব্রুয়ারি উদযাপনের ক্ষেত্রেও ঘটছে ছন্দপতন। করোনা মহামারির আগে ফেব্রুয়ারির মাস শুরুর সঙ্গে মাসব্যাপী নানামাত্রিক কর্মসূচি রাজধানীসহ সারা দেশে শুরু হলেও এবারও সে রকম আয়োজন হচ্ছে না। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে বাঙালির সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক আয়োজন অমর একুশে বইমেলা এবারও বিলম্বিত। জাতীয় কবিতা পরিষদের জাতীয় কবিতা উত্সবও পিছিয়ে মার্চের প্রথম সপ্তাহে করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
সার্বিক এই পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাষাসংগ্রামী লেখক-গবেষক আহমদ রফিক গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এই অবস্থায় বইমেলাসহ ফেব্রুয়ারির অন্যান্য আয়োজন দেরিতে হলেও ক্ষতি নেই। তবে যে বিষয়টির গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তোলা।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা গতকালই (রবিবার) প্রকাশক সমিতিকে চিঠি দিয়ে বলেছি, স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সরকারের যে শর্ত আছে তা প্রতিপালন করতে হবে। করোনা টিকা নিয়ে সবাইকে বইমেলায় আসতে হবে। বাংলা একাডেমির সবাইকে এ টিকা নিতে হবে। যাঁরা আগে প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তাঁদের দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিতে হবে। টিকা নেওয়া ছাড়া কেউ বইমেলায় প্রবেশের অনুমতি পাবেন না। সরকারের সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ- আলোচনা চলছে। টিকার কোনো সংকট নেই। ’
নূরুল হুদা বলেন, ‘বইমেলার জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতিও চলছে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে যদি বাণিজ্য মেলা হতে পারে, তা হলে বইমেলাতেও আমি অসুবিধার কিছু দেখছি না। আমরা আশা করছি, সংক্রমণ দ্রুত কমে আসবে এবং ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের পর বইমেলার উপযোগী পরিবেশ ফিরে পাব। ’
জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘মঙ্গলবার থেকেই জাতীয় কবিতা উত্সব শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু করোনার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। ’ সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাত বলেন, ‘আমরা জাতীয় কবিতা উত্সবের সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। মার্চের প্রথম সপ্তাহে এবার ৩৫তম জাতীয় কবিতা উত্সব হবে। ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর এবং আমাদের বিজয়ের ৫০ বছর হবে এ উত্সবের প্রতিপাদ্য। করোনার কারণে এবার ফেব্রুয়ারির শুরুতে এ উত্সব করতে পারছি না। ভারতের কলকাতায়ও করোনার কারণে বইমেলা পিছিয়ে দিয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি শুরুও করা হচ্ছে। ওই বইমেলারও থিম কান্ট্রি নির্ধারণ করা হয়েছে বাংলাদেশকে। ’