দাম্পত্যজীবনে সুখ

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি যা দাবী করে ইসলাম তা অস্বীকার করে না। বয়োপ্রাপ্তির পর একজন পুরুষ ও নারীর পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিক, আল্লাহপাক প্রদত্ত। পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ ইসলাম স্বীকার করে এবং নারী-পুরুষের একত্রে চলার ক্ষেত্রে একটি বৈধতার আবরণ দিয়েছে মাত্র। ইসলামে নারী ও পুরুষের মাঝে জৈবিক চাহিদা পূরণের ভিত্তি হলো বিবাহ। বিবাহ বহির্ভূত একত্র জীবনযাপন অত্যন্ত ঘৃণ্য, হারাম ও দণ্ডনীয় অপরাধ। ইসলামী সমাজে যিনা-ব্যাভিচার অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু বিবাহ খুব সহজ। দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও নারী মহরানার বিনিময়ে দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে পরস্পর ইজাব কবুল করলেই বিবাহ হয়ে যায়। এটি একটি সামাজিক চুক্তি এবং সেটি হতে হবে প্রকাশ্যে। অর্থাৎ মহল্লাবাসী জানবে যে, এই পুরুষ এবং নারী পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। রসুলুল্লাহ সা. ও সাহাবিদের জীবনে অধিকাংশ বিয়ে মসজিদে সম্পন্ন হয়েছে এবং ওলিমা হিসেবে খুরমা-খেজুর বিতরণ করা হয়েছে। বর সচ্ছল হলে ছাগল/দুম্বা জবেহ করে আত্মীয়-স্বজনকে খাওয়ানো হয়েছে। বিয়েতে মেয়ের অভিভাবকের কোনো খরচ নেই। উপরন্তু মহরানা দিয়ে মেয়েকে গ্রহণ করতে হয়। যৌতুকের তো প্রশ্নই ছিল না এবং আড়ম্বর বা নানা আনুষ্ঠানিকতাও ছিল না। তাই ছেলেমেয়ে সাবালক হলে সহজেই বিয়ে করতে পেরেছে। মহরানা নির্ধারিত হয়েছে সামর্থের ওপর। যার কিছুই নেই, এমন ব্যক্তি কুরআনের কিছু আয়াত শিখিয়ে দিবে এমন শর্তেও বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।

বিবাহের মাধ্যমে নর ও নারীর মাঝে পূর্ণতা আসে। মানবপ্রকৃতিতেই রয়েছে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ ও ভালোবাসা। দাম্পত্যজীবনে রয়েছে আনন্দ-স্ফুর্তি ও বিনোদন। শুধু বিনোদন নয় রয়েছে প্রভূত সওয়াব। সাহাবিরা রা. রসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে জানতে চান স্বামী-স্ত্রীর মাঝে আমরা যা করি সেটা তো আনন্দ-স্ফুর্তির জন্যই, এতেও কি সওয়াব? জবাবে রসুল সা. বলেন, ভিন্ন নারী-পুরুষে করলে কি গুনাহ হতো? জবাবে সাহাবিরা রা. বলেন, হ্যাঁ। তাই স্বামী-স্ত্রী যখন বৈধভাবে তাদের জৈবিক চাহিদা পূরণ করে তাহলে অবশ্যই সওয়াব হবে। তাদের পরস্পর আদর-আপ্যায়ন, হাস্যরস, কৌতুক সবকিছুতে রয়েছে সওয়াব। মানব প্রকৃতিতে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ দেয়ার পরও রসুলুল্লাহ সা. দাম্পত্যজীবনে সুখ-শান্তি বজায় রাখার জন্য নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর চমৎকার সব বাণী রয়েছে, ‘ঐ নারীই উত্তম যাকে দেখে স্বামী উৎফুল্ল হয়, প্রশান্তি অনুভব করে’। আবার বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম’। স্ত্রীর মনোরঞ্জণের জন্য রসুলুল্লাহ সা. স্ত্রীকে সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন, নিজে পরিপাটি থেকেছেন, আয়েশা রা. হাড়ের যেখানে কামড় দিয়েছেন হাত থেকে নিয়ে তিনিও সেখানে কামড় দিয়েছেন, গ্লাসে যেখানে ঠোঁট লাগিয়ে পানি খেয়েছেন তিনিও সেখানে ঠোঁট লাগিয়ে পানি খেয়েছেন। এ-সবই প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার নিদর্শন।

দাম্পত্য সম্পর্ক অটুট রাখা ও দাম্পত্যজীবনে সুখী হওয়ার জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, এক অপরকে অগ্রাধিকার দান ও ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা ছাড়া সুখী হওয়া সম্ভব নয়। ডেল কার্নেগি চমৎকারভাবে বলেছেন, ‘দাম্পত্যজীবনে সুখী হতে চান তাহলে পরস্পরকে অবিশ্বাস করবেন না আর ঘ্যানর ঘ্যানর করবেন না।’ পর্দাহীনতা ও অবাধ মেলামেশার ফলে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস (পরকীয়া) দারুণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গৃহে ঝগড়া-ঝাটি লেগেই আছে। আল্লাহর বিধানের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণই পারে এমন অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে।

প্রাচুর্য সুখের চাবিকাঠি নয়। সম্প্রতি বিল গেটস দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদ এবং অতি সম্প্রতি এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান ও ইভা রহমানের বিবাহবিচ্ছেদ প্রমাণ করে অঢেল প্রাচুর্য থাকার পরও তারা সুখী দম্পতি ছিল না। বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদ ও আত্মহত্যা অনেক বেড়ে গেছে এবং এর অন্যতম কারণ দাম্পত্যকলহ। দীর্ঘদিন একত্রে চলার মধ্যে মান-অভিমান, ঝগড়া-ঝাটি, কলহ-বিবাদ খুবই স্বাভাবিক। স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনেও ঘটেছে। এমন কিছু ঘটলে নিজেরাই দ্রুত সংশোধন করে নেয়া উচিত। সম্ভব না হলে পরিবারের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে। জমিনে জায়েজ কাজের মধ্যে সবচেয়ে অপছন্দনীয় হলো স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ (তালাক)। ইসলামে তালাকের ক্ষমতা পুরুষকে দেয়া হয়েছে। যত্রতত্র ব্যবহার নয়। অনেক প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। স্বামীর কর্তব্য নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে নেয়া ও স্ত্রীকে বোঝানো। তাতে না হলে বিছানা আলাদা করা, হালকা মারপিট করা এবং নিজেদের পক্ষে সম্ভব না হলে উভয় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মিমাংসার উদ্যোগ নেয়া। কোনো কিছুতে সম্ভব না হলে তখন স্বামী তিন পর্যায়ে স্ত্রীকে (তিন মাসে) তালাক দিবে। অবশ্য একান্ত বাধ্য হলে তালাক চাওয়ার অধিকার স্ত্রীর রয়েছে (খোলা তালাক)।

দাম্পত্যকলহ মিমাংসার ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের এগিয়ে আসা উচিৎ। কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলে অনেক সময় স্ত্রী মার বাড়ি চলে যায়। এক্ষেত্রে বাবা-মা এবং নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের উচিৎ তাদেরকে বোঝানো। শয়তানের সেরা কাজসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো। যারা এই পথে উদ্যোগী হয় শয়তান তাদের নিকট বন্ধু হিসেবে আবির্ভূত হয়। পরস্পরের হাজারো দোষ তাদের সম্মুখে উপস্থাপন করে। পক্ষান্তরে যারা মিমাংসার উদ্যোগ গ্রহণ করে তাদের এই কাজটি এতো প্রশংসনীয় যে, এক্ষেত্রে মিথ্যা বলা আর মিথ্যা থাকে না, সেটি পাপ না হয়ে সওয়াবে পরিণত হয়। যেমন, একটি দম্পতির মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে স্ত্রী তার মার বাড়িতে চলে গেল, এমতাবস্থায় একজন বানিয়ে বলে, ‘আপা ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল, ভাইতো তোমার জন্য অস্থির, দেখলাম চেহারা উসকু-খুসকু আমি যতক্ষণ তার কাছে বসা ছিলাম ততক্ষণ তোমার কথাই বললেন’। আবার ভাইকে গিয়ে বলে, ‘আপা তো আপনার চিন্তায় খাওয়া-দাওয়া সব বন্ধ করে দিয়েছে, চেহারা একেবারে শেষ হয়ে গেছে’। এ মিথ্যা মিথ্যা নয়, এটি সওয়াবের কাজ। ঠিক দুই ভাইয়ের বিরোধ মেটানোর ক্ষেত্রেও এমন আচরণ করা যায়। বিরোধ মিমাংসায় ভূমিকা রাখা কতো গুরুত্বপূর্ণ, পক্ষান্তরে যারা স্বামী-স্ত্রী বা ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধে উস্কানি দেয় তারা শয়তানের দোসর, নিকৃষ্টতম সৃষ্টি ও জাহান্নামের কীট।

আমাদের সামাজিক কালচারটা হলো, নিজের ছেলেমেয়ে ভুলের উর্ধে। অন্ধভাবে মা-বাবা তার সন্তানের পক্ষ নেয় এবং এতেই বিপত্তি ঘটে। নিজের সন্তানের প্রতি দুর্বলতা স্বাভাবিক। দোষের কিছু নয়। দোষ তখনই হয় যখন সমাধানের দিকে না গিয়ে প্রশ্রয় দেয়। অবশ্য সব বাবা-মা চান তাদের সন্তানদের সংসার টিকে থাকুক। আমার বড় ছেলের বিবাহোত্তর নববধূকে পারিবারিকভাবে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে আমি স্পষ্ট বলেছিলাম, ভবিষ্যতে যদি ছেলে ও ছেলেবৌর মাঝে বিরোধ দেখা দেয় আমি পুত্রবধূর পক্ষ নেব এবং মেয়ে-জামাইয়ের মধ্যে বিরোধ হলে আমি জামাইয়ের পক্ষ নেব। আমরা যদি এমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি তাহলে বিরোধ বেশিদূর এগোবে না ইনশা-আল্লাহ। আমি আরো বলি, আমাদের ছেলেরা হোক বৌপাগলা এবং মেয়েরা হোক পতিপরায়ণা। এমন সংসারে শান্তি বিরাজমান থাকাই স্বাভাবিক।

ইসলাম নারীকে মা, স্ত্রী ও কন্যা হিসেবে অপরিসীম মর্যাদা দান করেছে। মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। নারী জাতিকে হেয় করার জন্য বলা হয়, অর্ধেক জনশক্তিকে কর্মহীন রেখে জাতি অগ্রসর হতে পারে না। সংসারে মা বা স্ত্রীর কাজকে অর্থ দ্বারা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, স্ত্রী স্বামীর সংসারে রান্না-বান্না এমন কি সন্তানকে দুধ পান করাতেও বাধ্য নন। স্ত্রী সংসারে যা করে সবই সদকা অর্থাৎ দান এবং এর বিনিময়ে স্বামীর কাছ থেকে সর্বোচ্চমানে সদাচরণের পাশাপাশি আল্লাহর কাছে পাবে অফুরন্ত সওয়াব। আমরা লক্ষ করি সংসারে সবার আগে ঘুম থেকে জাগে মা বা স্ত্রী এবং সবকিছু গুছিয়ে সবার শেষে ঘুমাতে যায় একজন নারী। সন্তান লালন-পালন ও দুগ্ধদানের মতো কষ্টকর কাজের কারণে একটু বিরক্ত ও গালমন্দ করা সহ্য করার কথা হাদিসে বলা হয়েছে। হজরত ওমর রা.-এর খেলাফতের সময়ে জনৈক ব্যক্তি স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে খলিফার সাথে দেখা করতে আসেন। খলিফার বাড়ি তো আর রাজপ্রাসাদ নয়, সাধারণের বাড়ির মতই। খলিফার বাড়িতে এসে দেখেন, গৃহের ভেতরে খলিফার স্ত্রী তাঁকে খুব গালমন্দ করছেন। লোকটি ভাবলেন, আমি তো বিপদগ্রস্ত আছিই, আমার চেয়ে খলিফা আরো বেশি অসহায়। এটি ভেবে সে বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছেন। এমন সময় খলিফা বের হয়ে এসে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে ঘটনা বলার পর বললেন, আমার চেয়ে আপনাকে বেশি অসহায় ভেবে ফিরে যাচ্ছিলাম। খলিফা বললেন, ‘দেখ তারা আমাদের কতো খেদমত করেন। চারিত্রিক হেফাজতের পাশাপাশি সন্তানদের দুগ্ধপান, লালনপালন, রান্নাবান্নাসহ সংসারের সকল কাজ সম্পন্ন করেন। ফলে তাদের একটু কটূকথা, গালমন্ধ শুনতেই হয়’। এই হলো নারীর কাজ সম্পর্কে একজন মুসলিম শাসকের মূল্যায়ন। সংসারে স্ত্রীর নানাবিধ খেদমতের কারণে স্বামীর উচিত তার স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।

হজরত ফাতিমা রা. নারী জাতির আদর্শ। রসুলুল্লাহ সা. তাঁর কলিজার টুকরো আদরের কন্যা ফাতিমা রা.-এর জন্য যোগ্য স্বামী হিসেবে বাছাই করেছিলেন ইলম ও তাকওয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত দরিদ্র হজরত আলী রা.-কে। ফাতিমা রা. সংসারের সকল কাজ নিজ হাতে সম্পন্ন করতেন। তিনিও জানতেন, এতকিছু করা তাঁর দায়িত্ব না হলেও স্বামীর প্রতি এটি তাঁর ইহসান এবং আল্লাহ তাঁর মুহসিন বান্দাদের পছন্দ করেন। জাঁতা পিষতে পিষতে ফাতিমা রা.-এর হাতে ফোঁস্কা পড়ে যায় এবং তিনি বেশ কষ্ট পান। একদিন তাঁর পিতার কাছে একজন দাসী চান এবং সে-সময়ে তাঁর পিতা ছিলেন ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান। তিনি তাঁর আদরের কন্যাকে দাসীর পরিবর্তে অধিক সওয়াবের আমল শেখালেন – সুবহান আল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার। দুনিয়া নয়, আখেরাতই ছিল তাঁদের অগ্রাধিকার।

ইসলাম সবসময় মধ্যমপন্থা অবলম্বন অর্থাৎ ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের তাগিদ দেয়। কুরআন ও হাদিস থেকে আমরা নিজের পিতামাতা, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে উত্তম আচরণের তাগিদ পাই। অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে পিতা-মাতা, দাদা-দাদি ও নানা-নানিকে, কিন্তু সদাচরণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কেউ অবহেলার পাত্র-পাত্রী নয়। আমরা ফেসবুকে মাঝে-মধ্যে লক্ষ করি পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের এতো তাগিদ থাকলেও শ্বশুর-শাশুড়ি সম্পর্কে তেমন দেখি না। প্রশ্ন উঠে, শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা পুত্রবধূর কতটুকু দায়িত্ব বা জামাইয়ের দায়িত্বই বা কতখানি? আমার উপলব্ধি, সদাচরণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ফিতরাতের ধর্ম ইসলামে পিতা-মাতা ও শ্বশুর-শাশুড়ির মাঝে কোনো পার্থক্য রাখা হয়নি। আল্লাহপাক পুরুষকে কর্তৃত্বশীল করেছেন এবং পরিবারের সবার প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব প্রধানত পুরুষের। যদি কোনো মানুষের পুত্র না থাকে এবং শুধুই কন্য থাকে তাহলে অবশ্যম্ভাবী তার সকল দায়িত্ব অর্পিত হয় জামাইয়ের ওপর। আসলে মানবিক ধর্ম ইসলাম সকল ক্ষেত্রে ইহসান করার কথা বলে।

আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি হয় দ্বিবিধ উপায়ে। এক. রক্ত সম্পর্ক দুই. বৈবাহিক সম্পর্ক। চাচা-ফুফু রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় এবং বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে খালা-মামারাও সমমর্যাদার অধিকারী। ইসলামে এই আত্মীয়তার (সবধরনের আত্মীয়) সম্পর্ক বজায় রাখার জোর তাগিদ রয়েছে এবং রসুলুল্লাহ সা.-এর স্পষ্ট উক্তি, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না’। পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপনীত হলে তারা শৈশবের অবস্থায় ফিরে যায় এবং সে-সময়ে বাড়তি সেবাযত্ন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সন্তান পিতা-মাতার খেদমত করতে বাধ্য এবং অবশ্যম্ভাবী স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি অপেক্ষা তাঁরা অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। আল্লাহপাক নারীর ফিতরাতে সেবার মনেবৃত্তি দান করেছেন। সন্তান গর্ভে ধারণ, দুগ্ধদান, লালন-পালন নারীর প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যুদ্ধের ময়দানে পুরুষ যুদ্ধ করে এবং নারী আহতদের সেবা করে একজন মুজাহিদের সমান সওয়াব পায়। নারীর কর্মক্ষেত্র ঘর এবং পুরুষের কর্মক্ষেত্র বহিরাঙ্গন। শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা পুত্রবধূর দায়িত্বের অংশ না হলে সেই পরিবারে বিপর্যয় অবশ্বম্ভাবী। তখন বৃদ্ধাশ্রম ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না। স্বামীর আনুগত্য স্ত্রীর জন্য ফরজ। এমন কোনো স্বামী কি পাওয়া যাবে যার বাবা-মাকে অবহেলা, অনাদর করা হলে সেই স্ত্রীর প্রতি স্বামী সন্তুষ্ট হবে? ইসলামে তালাক যদিও জায়েজ কিন্তু খুবই অপছন্দনীয়। স্বামীর পিতামাতার প্রতি অবহেলা করলে সেই স্ত্রীকে তালাক দেয়া স্বামীর জন্য জায়েজ। স্ত্রীকে তালাক দেয়ার জন্য হজরত ওমর রা. তাঁর ছেলেকে বললে তিনি বিষয়টি নবি মুহাম্মদ সা.-এর কাছে পেশ করেন। রসুলুল্লাহ সা. বলেন, তোমার পিতা কি তালাক দিতে বলেছেন? জবাবে বলেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন, তাহলে তালাক দাও। হজরত ইব্রাহিম আ. তাঁর ছেলে ইসমাইল আ.-কে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার কথা বললে পরপর দুই স্ত্রীকে তিনি তালাক দেন। এই হলো সন্তানের কাছে পিতামাতার মর্যাদা।

ইসলাম পারিবারিক জীবনকে খুবই গুরুত্ব প্রদান করে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ব্যয় হলো আপন পরিবারের জন্য ব্যয়। সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার জন্য পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্যও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আজকে যে বধূ আগামী দিনে সেই মা/শাশুড়ি। যে দয়া করে না সে দয়া পায় না। পরস্পরের প্রতি দয়া-মায়া প্রদর্শনের মাধ্যমে পাওয়া যায় স্বস্তি। আমরা স্বামী-স্ত্রী, পিতামাতা-সন্তান, ভাই-বোনসহ সকল আত্মীয়স্বজন ও আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়ার্দ হই তাহলে আল্লাহও আমাদের প্রতি দয়ার্দ হবেন। রসুলুল্লাহ সা.-এর একটি হাদিস স্মরণ করে দিয়ে লেখার সমাপ্তি টানতে চাই, ‘জমিনে যারা আছে তাদের সাথে সদাচরণ করো, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও তোমাদের প্রতি সদাচরণ করবেন।’

প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

কলামিস্ট এবং সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল, কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button