নিকারাগুয়ার পুরাতাত্ত্বিক নগরী

মঈনুস সুলতান

ধুলা উড়িয়ে, পাথরকুচি ছিটকিয়ে ছোটে এসইউভি। আগ্নেয়গিরির উড়ে আসা ছাইয়ের কারণে কাঁচা সড়কটির রং কালচে। নুড়িপাথরগুলোও মরচে বর্ণের। মনে হয় আমরা লাভাস্রাবী শিলাচূর্ণ ছিতরিয়ে আগ বাড়ছি। গতকাল আমি নিকারাগুয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে ক্যাটল র‌্যাঞ্চের গেস্টহাউসে রাত কাটিয়েছি, তার স্বত্বাধিকারী সিনিওর হেরনানদেজ গলফ কোর্সে যাওয়ার পথে আমাকে লিফট দিচ্ছেন। আমাদের সামনে মাউন্টেন বাইক চড়ে এগোচ্ছে অটাম। গেল রাতে ক্যাটল র‌্যাঞ্চের গেস্টদের জন্য আয়োজিত হয়েছিল ক্যাম্পফায়ার ঘিরে বারবিকিউ। ওখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেড়াতে আসা তরুণী অটামের সঙ্গে খানিকটা কথাবার্তা হয়। মেয়েটি নাইটভিশন গগলস চোখে দিয়ে আগ্নেয়গিরির দিকে উড়ে যাওয়া বাদুড়দের পর্যবেক্ষণ করছিল। হেরনানদেজ গাড়ির গতি স্লো করে তাকে পাশ দেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লে অটাম মৃদু হেসে পেডাল মারে।

ক্যাটল র‌্যাঞ্চের মালিক সিনিওর হেরনানদেজ অত্যন্ত বিত্তবান হলেও নানা রকমের ছোটখাটো ব্যবসায়ে খাটছে তাঁর পুঁজি। তাঁর গেস্টহাউসে আছে ভাড়া দেওয়ার জন্য কতগুলো মাউন্টেন বাইক। চাইলে তরুণ বয়সী পর্যটকরা ওখান থেকে রাবারের ডিঙি নৌকা বা সার্ফিং বোর্ড ইত্যাদি ভাড়া করতে পারে। গাড়ির জানালা দিয়ে প্রান্তরের দৃশ্যপট দেখতে দেখতে ভাবি, অদৃষ্টে বিশ্বাসী অটাম আজ বাইক চড়ে যাচ্ছে কোথায়? তার ভাগ্যবাদী প্রবণতা সম্পর্কে আমি ওয়াকিফহাল হয়েছি সকালে ব্রেকফাস্টের সময়। ক্যাটল র‌্যাঞ্চে মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিল না। তো, অটাম ভোরবিহানে হাইক করে উঠে যায় ছোটখাটো একটি পাহাড়ে। চূড়া থেকে আইফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার করে সে পত্রিকায় রাশিচক্র কলামে ‘আজকের দিনটি কেমন যাবে’ খুঁটিয়ে দেখে নেমে আসে পাহাড় থেকে। তারপর ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘টুডে ইজ গোয়িং টু বি আ লাকি ডে টু ওয়াচ বার্ডস।’

kalerkanthoমিনিট দশেক নীরবে ড্রাইভ করে হেরনানদেজ ব্রেক কষেন। বিষয় কী, থামলেন কেন, জানতে চেয়ে তাঁর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালে তিনি রহস্যময় ভঙ্গিতে হেসে অনুরোধ করেন, ‘পর ফাভর মিরে আ লা ইসকিয়েরদা’ বা ‘বাঁ দিকে তাকান প্লিজ।’ আমি জানালা দিয়ে গলা বাড়াই। দিগন্তের কাছাকাছি সরোবরের জলে রোদের তীব্র কিরণে ছড়াচ্ছে বেগুনি মেশা রুপালি আভা। তার ঠিক মাঝখান থেকে আকাশ পানে মাথা তুলছে—একটি নয়, দুটি আগুনপাহাড়। এতক্ষণ পর্যন্ত আমি মমোতমবো নামের পিরমিডিক্যাল শেপের একটি পাহাড় সম্পর্কে সচেতন ছিলাম। কাছাকাছি দুটি ছোট-বড় আগ্নেয়গিরিকে জোড় বেঁধে একত্রে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্রেফ তাজ্জব বনে যাই! এই প্রেক্ষাপট থেকে পাহাড় দুটির শেপকে দেখায় খানিকটা গোলাকার বেজায় জগদ্দল প্রাকৃতিক স্ট্রাকচারের মতো। হেরনানদেজ এসপানিওলে ব্যাখ্যা করেন, ‘সুদীর্ঘ পাহাড়টি মমোতমবো, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা চার হাজার ২৫৫ ফুট, তুলনামূলকভাবে খাটো পাহাড়টির নাম মমোতমবিতো, তার শৃঙ্গ দুই হাজার ৭৮৬ ফুট ওপরে, তবে যত সহজে মমোতমবোর চূড়ায় হাইকাররা পৌঁছতে পারে, মমোতমবিতোর চূড়ার পথটি অতটা সুগম নয়। আমি কিন্তু চলমান এসইউভির জানালা থেকে তাদের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকি।

আমাদের গাড়িটি চলে আসে যে সরোবর—লেক মানাগুয়ায় যুগল আগুনপাহাড়ের অবস্থান—তার কিনারে। পার ধরে গাড়িটি আগ বাড়ে ধীরলয়ে। এই প্রেক্ষাপট থেকে আগ্নেয়গিরি দুটিকে ফের ত্রিভুজাকৃতির পিরামিডের মতো দেখায়। লেওন ভিয়োখোর পুরাতাত্ত্বিক সাইটের গেটে সিনিওর হেরনানদেজ আমাকে নামিয়ে দেন। কথা হয়, বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব। তিনি গলফ কোর্স থেকে ফেরার পথে আমাকে পিক করে নেবেন।

আর্কিওলজিক্যাল সাইটের পর্যটনী আপিস থেকে আমি টিকিট কিনি। সঙ্গে পাওয়া যায়—পুরাকালের প্রাকৃতিকভাবে সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়া—জনমানুষহীন বিরান এক নগরীর ইতিবৃত্ত সংবলিত ব্রশিয়ার। আপিস থেকে কিছু কিছু পর্যটক সামান্য পয়সার বিনিময়ে ট্যুর গাইড ভাড়া করছেন। কখনো কখনো একা পর্যটন করতে আমার ভালো লাগে। তাই গাইড ছাড়াই আগ বাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাই, অটাম এসে পৌঁছে একটি গাছের গোড়ায় তার মাউন্টেন বাইকটি চেইন দিয়ে বেঁধেছেদে লক করছে। আমি হাত তুলে ওয়েভ করলে  সেও হাত নেড়ে জবাব দিয়ে হেঁটে যায় পর্যটনী আপিসের দিকে। বয়স্ক এক দম্পতি আমার সামনে দিয়ে গাইড ছাড়া হাঁটছেন। তাঁরাও আমার দিকে চেয়ে হাত নাড়েন। আমি তাড়াহুড়া না করে শিলাপাথরের ছোট্ট ঢিবির মতো ধ্বংসস্তূপের পাশে পাতা একটি বেঞ্চে বসে ডিকশনারি ঘেঁটে ব্রশিয়ারটি পড়ি।

নিকারাগুয়ার সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের নজরে পড়ে পঞ্চদশ শতাব্দীর পয়লা দিকে।  ক্রিস্টোফার কলম্বাস তাঁর চতুর্থ অভিযাত্রায় পাশের দেশ হন্ডুরাস থেকে সৈন্য-সামন্ত ও যুদ্ধজাহাজ নিয়ে হামলে পড়েন নিকারাগুয়ার সমুদ্রতটে ১৫০২ সালে। সে আমলে এ এলাকায় বাস করছিল আমেরিকা মহাদেশের আদিবাসী (যারা ভুলবশত রেড ইন্ডিয়ান নামে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিচিত) চরোতেগা, নিকারাও, সাবাতিয়াবা প্রভৃতি গোত্র। কলম্বাসের স্প্যানিশ আক্রমণ এসব আদিবাসী সম্প্রদায় সাহসের সঙ্গে প্রতিহত করে। যুদ্ধে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির কারণে টিকতে না পেরে কলম্বাস পিছু হটেন। ১৫২২ সালে ফ্রানসিসকো করডোবার নেতৃত্বে স্প্যানিয়ার্ডরা ফের হামলা চালালে যুদ্ধক্ষেত্রে সে যুগের নিরিখে আধুনিক সমরাস্ত্রের আধিপত্যের কারণে আদিবাসীরা মারাত্মকভাবে পরাস্ত হয়। দেশটি সফলভাবে বিজিত করার জন্য করডোবাকে এসপানিওলে কনকিসাতাডোর বলা হয়। করডোবাই ঠিক এই জায়গায় (বর্তমানে যা লেওন ভিয়েখো নামে পরিচিত) স্থাপন করেছিলেন স্প্যানিশ উপনিবেশের রাজধানী। যতটা জানা যায়, সে আমলে এ এলাকায় গ্রামগুলোতে বাস ছিল প্রায় পনেরো হাজার আদিবাসীর। করডোবার ঔপনিবেশিক আমলা-পেয়ালারা আদিবাসীদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে তাদের নিয়োজিত করে খনিতে স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু আহরণে। তাদের সংসারের সোমত্ত মেয়েদের ছিনতাই করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্ন দেশের দাস-বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাহাজ ভাসিয়ে এ দেশে আসা নাবিক ও প্রশাসকরা তাদের গৃহে আদিবাসী তরুণীদের রাখনি হিসেবে রাখত। ফলত হালজামানায় নিকারাগুয়েনসে নামের বাদামি গাত্রবর্ণের এসপানিওলে কথা বলনেওলা যে মূলধারার মানুষজন নিকারাগুয়া শাসন করছে—তারা আদতে স্প্যানিশ কনকিসতাডোর বা পুরুষ অভিযাত্রী ও নিকারাগুয়ার লুণ্ঠিত আদিবাসী নারীদের বংশধর। মিশ্রিত এই জাতিসত্তা স্থানীয়ভাবে ‘মাস্তিসো’ নামে পরিচিত। এরা ছাড়া এ দেশে এখনো বসবাস করছে বেশ কিছু আদিবাসী গোত্র।

স্বর্ণ বেচাকেনার আড়ং হিসেবে লেওন ভিয়েখো পরিণত হয়েছিল সে জামানার এক জমজমাট নগরীতে। তবে ঔপনিবেশিক এই শহরের তমতমি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ষোল শতকের পয়লা দিকে মমোতমবোর অগ্ন্যুৎপাতের সঙ্গে সঙ্গে এ এলাকা ভূমিকম্পের কবলে পড়ে। প্রথম কয়েক বছর স্প্যানিশ প্রশাসকরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না কী করবেন। তবে ১৬১০ সালে ভূমিকম্পে লেওন ভিয়েখোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে অবশেষে নগরী এখান থেকে সরিয়ে বিশ মাইল দূরে—বর্তমানে যেখানে লেওন নগরী অবস্থিত, ওখানে রিলকেট করা হয়। তো, বর্তমানের লেওন নগরীটি আদতে এই পুরাতাত্ত্বিক নগরীর স্থানান্তরিত বিকাশ। আমি উঠে এর ধ্বংসপ্রাপ্ত অবয়বটি সরেজমিনে দেখার জন্য এবার আগ বাড়ি।

kalerkantho

পাথরের গাঁথুনিতে কোথাও বর্গক্ষেত্র আবার কোথাও লম্বাকৃতির স্ট্রাকচারগুলোর ভিত পড়ে আছে। দু-চারজন পর্যটক ঘুরেফিরে ছবি তুলছেন। এই ভিতগুলো দেখে আন্দাজ করা কঠিন—ঠিক এই জায়গায় আজ থেকে চার শ বছর আগে পরিশোধিত হতো নানা রকমের ধাতু। জড়ো হতো সুবর্ণবণিকরা, দিনভর চলত বেচাকেনা। একটি অট্টালিকায় নিলামে বিক্রি হতো লুট করে আনা আদিবাসী কুমারীদের। আমি হেঁটে পেরিয়ে যাই গির্জা, কারাগার, খাজনার তহশিল ও রঙ্গশালার পাথুরে কাঠামো। কিছু কিছু স্ট্রাকচার ঘিরে হালকা ঝোপঝাড়। এদিকে ডালপালা ছড়ানো গাছপালাও প্রচুর। ফের দেখা হয় অটামের সঙ্গে। মেয়েটি ঝোপ থেকে ঝোপে নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে তুলছে ডালে বা পাতার আড়ালে বসে থাকা পাখিদের ছবি। আমার সঙ্গে চোখাচুখি হতেই সে মৃদু হেসে বলে, ‘দিস প্লেস ইজ আ রিয়াল প্যারাডাইজ অব বার্ডস।’ প্রতিক্রিয়ায় আমি বলি, ‘হোয়াট ডু ইউ নো আবাউট বার্ডস অব নিকারাগুয়া?’ সে জবাব দেয়, ‘এ দেশে মোট ৭৮১ প্রজাতির পাখি বসবাস করে। এ ছাড়া অতিথি পাখি তো আছেই। বেশ কিছু বিরল প্রজাতির পাখির তালাশ কেবল নিকারাগুয়াতেই পাওয়া যায়।’ আমি এবার জানতে চাই, ‘তুমি সুন্দর কোনো পাখির ফটোগ্রাফ তুলতে পেরেছ কি, অটাম?’ সে ক্যামেরার স্ক্রিন আমার চোখের সামনে তুলে ধরে বলে, ‘ওহ ইয়েস, লুক, হোয়াট আই ক্যাপচারড।’ ক্যামেরার স্ক্রিন ঝলমল করে ওঠে গোয়ারদাবারনকো নামের দারুণ রকমের বর্ণাঢ্য পাখির উপস্থিতিতে। নাট্যমঞ্চে লোকপ্রিয় নায়িকার মতো নিকারাগুয়ান সংস্কৃতিতে এই পাখির স্টার স্ট্যাটাস আছে। জাতীয় পাখি হিসেবে মর্যাদাবান এই খেচরটির ছবি ক্যালেন্ডার ও বিলবোর্ডে সর্বত্র আকসার দেখা যায়। কোনো কোনো তরুণী বাহু কিংবা খোলা কাঁধে এদের উল্কি করা ইমেজ যুক্ত করে নিজেদের সৌন্দর্য সমৃদ্ধ করে থাকে। পরের ফ্রেমে আমি চাচালাকা বলে আরেকটি ইন্টারেস্টিং পাখির আলোকচিত্র দেখতে পাই। ঝোপের তলা দিয়ে কালো পালকের বড়সড় একটি হাঁস হেঁটে এলে ‘অহ মাই সুইট লর্ড, দিস ইজ কোরাসো…দিস বার্ড ইজ সো রেয়ার, এরা ওড়ে কম, ঝোপের নিচে হেঁটে হেঁটে পোকা-মাকড় ধরতে ভালোবাসে’, বলে অটাম ক্যামেরা বাগিয়ে অনুসরণ করা গোয়েন্দার মতো নিঃশব্দ পদক্ষেপে পাখিটির পিছু পিছু ছোটে। কোরাসো নামের বৃহৎ খেচরটি তার হলুদ ঠোঁট বাঁকিয়ে থেমে যেন পোজ দেয়। আমি অটামের ছবি তোলায় অন্তরায় হতে চাই না, তাই আবার দুপাশে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘর-দুয়ারের ভেতর দিয়ে পথ চলি।

আমার পেছন পেছন আসে লাকি চার্ম বা কবজিতে জড়ানোর ছোট্ট ছোট্ট মালা নিয়ে এক আদিবাসী মহিলা। সে বিডের মালাগুলো ঝনঝনিয়ে নাকি সুরে আওয়াজ দেয়, ‘আমুলেটো দেলা সুয়ার্তে, মুই বারাতো’ বা ‘কবজিতে জড়ানোর সৌভাগ্যসূচক চার্ম, খুব সস্তা।’ আমি ঘুরে তাকাতেই চাঁদের মতো গোলগাল মুখের মহিলা করুণভাবে হেসে বলেন, ‘কম্প্রে পর ফাভর’ বা ‘প্লিজ একটি লাকি চার্ম আমার কাছ থেকে কিনুন, সিনিওর।’ তাঁকে বিমুখ করতে পারি না, তাই দাঁড়িয়ে পড়ে কিনি একটি চার্ম।

kalerkantho

ধ্বংসস্তূপে একটি পাথুরে ভিতের কাঠামোতে দর্জির ফিতা দিয়ে মাপজোখ করে নোট নিচ্ছেন হ্যাট মাথায় শুভ্রশ্মশ্রু এক বৃদ্ধ, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। চোখাচুখি হতেই মহিলা হেসে হাত নাড়েন। আমি তাঁদের হ্যালো বলতে এগিয়ে যাই। মি. টমাস ফ্যালাচি ও মিসেস শ্যারোল ফ্যালাচি আমেরিকা থেকে পর্যটক হিসেবে লেওন ভিয়েখোতে বেড়াতে এসেছেন। দুজন একযুগে মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করতেন। বছর কয়েক হলো এঁরা অবসর নিয়েছেন। এঁরা একই সঙ্গে পড়িয়েছেন ইতিহাস ও আর্কিওলজি। অধ্যাপক টমাসের এক্সপার্টিজ বিগত জামানায় ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরসমূহের পুরাতত্ত্বে। অধ্যাপক শ্যারোলের আগ্রহ মৃৎপাত্রের গায়ে আঁকা চিত্র ও প্রতীকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে। টমাস সাহেব সম্ভবত ভুগছেন পার্কিনসোঁ রোগে। মাপজোখ করতে গিয়ে তাঁর হাত কেবলই কাঁপে। শ্লেষ্মা জড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, লেওন ভিয়েখো নগরীটি পুরো তিন শতাব্দী ছিল আগ্নেয়গিরির ছাই ও লাভাস্তরের নিচে লুকানো। ১৯৬৭ সালে যখন আর্কিওলজিস্টরা নগরীর এই ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে বের করেন, তত দিনে লেওন ভিয়েখোর সঠিক অবস্থান মানুষজনের স্মৃতি থেকে মুছে যেতে বসেছে। অধ্যাপক টমাস ফ্যালাচি ডক্টরাল স্টুডেন্ট হিসেবে তাঁর অ্যাডভাইজার এক অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে এখানকার খোঁড়াখুঁড়িতে অংশ নিয়েছিলেন। তখন থেকেই তাঁর ইচ্ছা লেওন ভিয়েখো নিয়ে লিখবেন একটি গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধ। তারপর নিকারাগুয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হলে আমেরিকার একাডেমিক গবেষকদের এদিকে আসা দুরূহ হয়ে পড়েছিল। এখন অবশ্য যাতায়াতে কোনো সমস্যা নেই, তিনিও অবসর নিয়ে হাতে পেয়েছেন প্রচুর সময়। তাই তাঁরা দুজনই এসেছেন মাঠ পর্যায়ে সরেজমিনে ডাটা কালেক্ট করতে। ইচ্ছা—যে প্রবন্ধটি এত বছর লেখা হয়ে ওঠেনি সেটি তৈরি করে ফেলা।

ফ্যালাচি দম্পতির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আবার ধ্বংসস্তূপ ডিঙিয়ে সামনে বাড়ি। চলে আসি ‘কায়ে রয়াল’ নামের একটি সরণিতে। ব্রশিয়ার পড়ে জেনেছি, যেসব আদিবাসী মানুষ ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের হুকুম আমান্য করত বা যারা খনিতে শ্রম দিতে অস্বীকার করত, তাদের হাতকড়া পরিয়ে এই কায়ে রয়াল ধরে নিয়ে যাওয়া হতো সরণির শেষ প্রান্তে ‘প্লাজা মায়োর’ বা মেইন স্কয়ারে। ওখানে ওদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে বা শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হতো। প্লাজা মায়োরে এসে লাকি চার্ম বিক্রেতা আদিবাসী মহিলার ফের সাক্ষাৎ পাই। এখানে আদিবাসী বিদ্রোহী এক পুরুষের মূর্তিও আমাকে অবাক করে। এ স্ট্যাচুটির নাম ‘মনুমেনতো আ লা রেজিসটেনসিয়া’ বা ‘প্রতিরোধের মিনার’। দেখি, আদিবাসী মহিলা ওখানে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করছেন। যদিও সফল হয়নি, নিকারাগুয়ার আদিবাসী মানুষজন বারবার ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিবাদ করেছে। তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে স্পানিয়ার্ড সৈনিকরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করত। স্পেন থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে কলম্বাসের সাঙ্গোপাঙ্গর এই এলাকায় আসার আগে আদিবাসীরা কখনো কুকুর বা ঘোড়া দেখেনি। প্রতিবাদরত আদিবাসীরা দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পরাস্ত হতো স্প্যানিয়ার্ড ঘোড়সওয়ার সৈনিকদের গতির কাছে। আর হিংস্র কুকুরগুলোও ছড়াত দারুণ সন্ত্রাস। তার পরও তারা প্রতিবাদ বহাল রেখেছিল যুগ যুগ ধরে। আমি মূর্তির পা কামড়ে ধরা কুকুরটির দিকে তাকিয়ে থাকি। আদিবাসী মহিলা একমুঠো ধুলোমাটি তুলে তা দিয়ে লেপে দেন কুকুরটির চোখ-মুখ। তাঁর দিকে তাকিয়ে জানতে বাসনা হয়, এই মহিলার কোনো পূর্বপুরুষ কি মৃত্যুদণ্ডের আসামি হয়ে এই স্কয়ারে ত্যাগ করেছিলেন তাঁর শেষনিঃশ্বাস?

kalerkantho

হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীর এক প্রান্তে। পাশাপাশি দুটি সমাধির কাছে দাঁড়িয়ে ফলক পড়ে জানতে পারি, একটি কবরে গোর হয়েছিল কনকিসতাডোর ফ্রানসিসকো করডোবার। পাশেই সমাহিত হয়েছিলেন স্প্যানিশ উপনিবেশের গভর্নর পেডরাসিয়াস ডাবিলা। শেষ বয়সে ক্ষমতার গজদন্ত মিনার থেকে পতন হয়েছিল করডোবার। তাঁকে হটিয়ে দিয়ে শাসনদণ্ড হাতে নিয়েছিলেন পেডরিয়াস ডাবিলা। তিনি করডোবাকে মেইন স্কয়ারে শিরশ্ছেদ করেছিলেন। যে কবরে করডোবার মস্তকহীন দেহটি সমাহিত হয়েছে, পরবর্তী যুগে গভর্নর ডাবিলাকে তার পাশে অন্য একটি কবরে গোর দেওয়া হয়। তাঁদের জোড়া কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আমি সেই আমলের লেওন ভিয়েখো নগরীর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে ভাবছিলাম। চিলচিৎকারে আমার ভাবনার ধারাস্রোত ছলকে ওঠে। দেখি, খানিক দূরে একটি ঝোপের ওপারে গাছের তিনডালা কাণ্ডটি থেকে ঝুলে সাত-আট ফুট নিচে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে অটাম। গোটা পাঁচেক নাম না-জানা পাখি উড্ডীন হালতে তাকে ঘিরে কর্কশ গলায় কাকলি করে উড়ছে আর থেকে থেকে তীক্ষ ঠোঁটে ঠোকরাচ্ছে অটামকে। সে এক হাতে ঝুলে থেকে অন্য হাতে হামলাকারী খেচরদের তাড়াতে চাচ্ছে। গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে পড়েছে তিন-চারজন আদিবাসী ফেরিওয়ালা। তারা স্রেফ তামাশা দেখছে। ঠিক বুঝতে পারি না, অটাম গাছে চড়তে গেল কেন? আমি জোরকদমে ঝোপ ডিঙিয়ে আগ বাড়ি। গাছের নিচে পৌঁছার আগেই অটাম জুপ্পুৎ করে পড়ে তলায়।

অটামকে হতভম্ব দেখায়। সে ‘আই অ্যাম টোটালি শেইকেন, দিজ বার্ডস আর সো অ্যাগ্রেসিভ’ বলে ওপরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আকাশে কয়েকটি মাঝারি মাপের পাখি উড়ে উড়ে ছড়াচ্ছে অস্থিরতা। আমি তাকে নিয়ে উল্টো দিকে হেঁটে দ্রুত সরে যেতে থাকি অকুস্থল থেকে। একটি খেচরের চঞ্চুর আঘাতে তার গ্রীবা থেকে গড়িয়ে নামছে রক্ত। আমি দাঁড়িয়ে পড়ে ব্যাকপ্যাক থেকে বের করি ফার্স্ট এইড কিট। অ্যালকোহলিক রাব দিয়ে রক্ত মুছিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজের স্টিকার জুড়ে দিলে অটাম মৃদু হাসে। তার চোখ-মুখ এবার একটু রিলাক্স হয়। বিচিত্র এই আক্রমণাত্মক পাখিগুলোর নাম সেও জানে না। তবে গাছে চড়ে সে একটি পাখির বাসায় চিঁউচিঁউ করা তিনটি শাবকের ছবি তুলে নিয়েছে। ছবি যখন আছে—বার্ডবুক দেখে বা ইন্টারনেটে ব্রাউজ করে এদের পরিচয় জেনে নেওয়া কঠিন হবে না।

হাঁটতে হাঁটতে অটামকে আরেকটু জানার জন্য আমি প্রশ্ন করি, ‘পাখি সম্পর্কে তোমার কী অভিজ্ঞতা আছে, অটাম?’ সে জবাব দেয়, ‘আলাবামার একটি ফার্মে আমি বড় হই, আমার বাবা ঘোড়ায় চড়া কাউবয়। আমাদের বাড়ির উঠানে বাবা জালিতার দিয়ে একটি বার্ডহাউস বানিয়েছিল। ওখানে নীড় থেকে তুলে নিয়ে এসে বাবা বাচ্চা পাখিদের পালত। তখন মা-পাখিরা বার্ডহাউসের চারপাশে উড়ে উড়ে আহাজারি করত। কিন্তু এভাবে দল বেঁধে আক্রমণ করার ব্যাপারটা আমি কখনো চাক্ষুষ করিনি।’ শুনে আমি এবার জানতে চাই, ‘হোয়াট ইজ অল দ্যাট ইন্টারেস্টিং আবাউট বার্ডস, যে তুমি—অটাম এ রকম হন্যে হয়ে তাদের পেছনে লেগে আছ?’ মৃদু হেসে সে জবাব দেয়, ‘দে আর জাস্ট দ্য বান্ডল অব ফ্লাইং জয়, তাদের উড়ে বেড়ানোর স্বাধীনতাকে আমার হিংসা হয়। তারা যে রকম ফ্রিডম এনজয় করে, আমি অতটা সৌভাগ্যবান নই, সামটাইমস আই ফিল লাইক আই ডোন্ট হ্যাভ দ্য ফ্রিডম দ্যাট দ্য বার্ডস হ্যাভ।’ আমি কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটি, তারপর জিজ্ঞেস করি, ‘মা-পাখিদের কাছ থেকে শাবকদের কেড়ে আনার কোনো অধিকার তোমার নেই, ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দিস, অটাম?’ সে রেগে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আমার চোখে চোখ রাখে। কী যেন ভাবে, তারপর বলে, ‘ইটস নট মি, ইটস মাই ফাদার—যে পাখির শাবক চুরি করা পছন্দ করে। মা-পাখিদের আহাজারি আমি সহ্য করতে পারতাম না, তাই বার্ডহাউসের দরজা ফাঁক করে রেখে তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতাম। অ্যান্ড ইউ নো হোয়াট, আই ওয়াজ পানিশ ফর দ্যাট এগেইন অ্যান্ড এগেইন।’ শুনে আমি চুপ মেরে যাই। অটামও চুপচাপ আরো কয়েক পা সামনে বাড়ে, তারপর ফের দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, ‘আমার বাবা পাখির শাবকদের ছেড়ে দেওয়ার অপরাধে মাসের পর মাস আমাকে কোনো পকেট-মানি না দিয়ে কষ্ট দেয়। স্কুলে আমি আইসক্রিম বা ক্যান্ডি কিনতে পারতাম না। একবার পেঁচার দুটি শাবককে ছেড়ে দিলে বাবা জ্বলন্ত সিগার আমার শরীরে চেপে ধরেছিল। ডু ইউ ওয়ান্ট সি মাই বার্নড স্পট?’

একটু সময় মৌন থেকে আমি ক্ষমা চেয়ে বলি, ‘স্যরি ফর মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইউ, অটাম। মাই অ্যাপোলজিস।’ হঠাৎ করে তার মুড ভালো হয়ে ওঠে। চোখে-মুখে চটুলভাব ফুটিয়ে তুলে সে বলে, ‘ইউ নো হোয়াট, আই ফিল লাইক টু টেল ইউ সামথিং, তুমি শুনতে চাও?’ আমি আগ্রহ দেখিয়ে বলি, ‘অহ ইয়েস অটাম, প্লিজ গো অ্যাহেড।’ সে লাজুকভাবে বলে, ‘ঘুম থেকে উঠেই আমি রাশিচক্রে আজকে আমার দিনটি কেমন যাবে তা চেক করি। ওখানে পরিষ্কার ভবিষ্যদ্বাণী দেখলাম, দুপুরের দিকে ছোটখাটো একটি ফাড়া আছে। তা কেটে গেলে এমন একজনের সঙ্গে দেখা হবে, যে তোমাকে সুন্দর একটি উপহার দিতে পারে।’ অটাম থুতনিতে আঙুল রেখে  ফেমিনিন ভঙ্গিতে জানতে চায়, ‘আর ইউ দ্য ওয়ান হু ইজ গোয়িং টু গিভ মি আ নাইস লিটল গিফট?’ আমি কোনো দ্বিধা না করে জবাব দিই, ‘অহ ইয়েস অটাম, আই অলরেডি বট দ্য গিফট’ বলে আদিবাসী নারীর কাছ থেকে কেনা লাকি চার্মটি তার হাতে তুলে দিতে দিতে বলি, ‘অটাম, লেটস গো অ্যান্ড ফাইন্ড আ রেস্টুরেন্ট টু ইট লাঞ্চ, আই উড লাইক ট্রিট ইউ।’

পুরাতাত্ত্বিক সাইটের কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে এসে খানিক সামনে হেঁটে গিয়ে আমরা লেক মানাগুয়ার পারে একটি ছনে ছাওয়া রেস্তোরাঁর সন্ধান পাই। জ্বলন্ত গ্রিল থেকে মসলাদার আধপোড়া মাছের ঘ্রাণ বাতাসকে ভারী করে তুলছে। হল কামরা পেরিয়ে সরোবরের জলের ওপর কাঠের ডেকে বসতে গিয়ে দেখি পারের বাগানে ফ্যালাচি দম্পতি। অধ্যাপক মিসেস শ্যারোল ফ্যালাচির হঠাৎ শরীর খারাপ লাগছে। তিনি হ্যামোক বা দড়ির দোলনায় শুয়ে পড়েছেন। অধ্যাপক টমাস ফ্যালাচি একটি ব্যাটারি লাগানো ফ্যান তাঁর মাথার কাছে টুলের ওপর রেখে কাঁপা হাতে মেশিনে মাপছেন স্ত্রীর ব্লাড প্রেসার। একটু আগে তাঁদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ কথাবার্তা হয়েছে, তাই খাবারের অর্ডার করে অটামকে কাঠের ডেকে একা বসিয়ে রেখে তাঁদের খোঁজ নিতে যাই। টেনশনে মনে হয় টমাস সাহেবের সারা শরীর মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তিনি কেশে গলা সাফ করে বলেন, ‘হার্ট অ্যাটাকের পর রোদে হাঁটাহাঁটি করলেই শ্যারোলের মাথা ধরে, মাইগ্রেনের ব্যাপারটা তাঁকে বড় ভোগাচ্ছে। আমি ক্যাপসুল খাইয়ে দিয়েছি, ধাতস্থ হতে মিনিট পনেরো লাগবে, নাথিং সিরিয়াস..।’ আমি ফিরে আসি অটামের কাছে। খুবই সাদামাটা রেস্তোরাঁ, তবে লেক মানাগুয়ার ওপর ছনের দোচালা ঘরের লাগোয়া খোলামেলা কাঠের ডেকে বসতে দারুণ লাগে। গ্রিল করা তাজা মাছটির স্বাদও আমরা উপভোগ করি। সঙ্গে মুচমুচে করে ভাজা চাকতি চাকতি প্লানটিন বা কাঁচকলা। আমরা কাঠি দিয়ে গেঁথে প্লানটিনের চাকতি খেতে খেতে তারিয়ে তারিয়ে তপ্ত কাকাও পান করি। সরোবরের মাঝ বরাবর দুপুরের তীব্র রোদে চূড়ায় মৃদু বাষ্প উড়িয়ে মমোতমবিতো পাহাড়টি যেন ঝিমায়।

হঠাৎ করে ‘অহ মাই গড, দে আর হিয়ার’ বলে আঁতকে ওঠে অটাম। তার হাতে ধরা কাকাওয়ের মগে তপ্ত তরল ছলকে যায়। সে আকাশের দিকে ইশারা করে অস্ফুট আওয়াজে বলে, ‘আর দে রিয়েলি দ্যাট অ্যাগ্রেসিভ…?’ আমি তার ইশারা অনুসরণ করে দেখি, ঠিক মাথার ওপর চক্রাকারে উড়ছে—একটি বা দুটি নয়, মোট আটটি নাম না-জানা পাখির ঝাঁক। চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না, এরাই ঘণ্টাখানেক আগে আক্রমণ করেছিল অটামকে। পাখি তো নয়, রীতিমতো এক গ্যাং যেন দলবল জুটিয়ে ফিরে এসেছে ভিকটিমকে আরেক দফা হেনস্তা করার জন্য। আমরা তটস্থ হয়ে বসে থাকি, খানিক ঘুরপাক করে খেচরের ঝাঁক ছনের ছাউনিওয়ালা রেস্তোরাঁয় আগ্রহ হারিয়ে সরোবরের জলের ওপর দিয়ে গ্লাইড করে উড়ে যায় মমোতমবো পাহাড়ের দিকে। অটাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘দিস বার্ডস হ্যাভ দ্য রিয়াল ফ্রিডম টু ফ্লাই, আমার কিন্তু তাদের মতো স্বাধীনতা নেই, এদের উড্ডয়ন রেখার দিকে তাকালেই আমার জেলাস লাগে।’

আমি এবার প্রশ্ন না করে পারি না, ‘অটাম, ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা তোমার নেই, এটা তোমার মনে হয় কেন?’ জ্যাকেটের পকেট থেকে লাকি চার্মটি বের করে তার বিড টিপতে টিপতে সে জবাব দেয়, ‘আই অ্যাম আ কলেজ গার্ল। আমার উপার্জন খুব সামান্য। কলেজের টিউশন ফি থেকে জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে আমি এখনো আমার বাবার ওপর নির্ভরশীল। অ্যান্ড আই লাইক ইউ টু নো দ্যাট আই হেইট মাই ফাদার।’ আমার পরবর্তী কৌতূহল হয়, ‘কিন্তু কেন অটাম, হোয়াই ইউ হেইট ইওর ফাদার?’ কেমন যেন ভাবনার ভেতর অন্যমনস্ক হতে হতে সে জবাব দেয়, ‘ছোটবেলা আমি যখন বেবি সিটারের কাছে থাকতাম, বাবা দুপুরবেলা ফিরে আসত, আমার হাতে চকোলেট আইসক্রিমের বাটি ধরিয়ে—ভিডিওর সামনে বসিয়ে দিয়ে…তোমাকে কী বলব…নিচতলার বেইসমেন্টের কামরাটিতে…হি ওয়াজ অ্যাকচুয়ালি ইউজ টু স্ক্রু মাই বেবি সিটার। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে খিটিমিটি বাধল, তাদের সেপারেশন হলো, কয়েক মাস পর তাদের ফের মিলমিশ হলো, সে অনেক কথা।’ কোনো চিন্তা-ভাবনা না করে আমি জিজ্ঞেস করে বসি, ‘তোমার মা-বাবা…আর দে টুগেদার? এখন কি তাঁরা একসঙ্গে বসবাস করছেন, অটাম?’ কোনো দ্বিধা না করে সে জবাব দেয়, ‘আজ থেকে আড়াই বছর আগে আমি যখন কলেজ হোস্টেলে গেলাম, মা সমস্যাটি আরো জটিল করে তুলল। বাবা নাকি তার এক বান্ধবীর সঙ্গে ইটিসপিটিস করছিল, অ্যান্ড হি ওয়াজ কট রেড হ্যান্ডেড। মা আমাকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ছাড়ল।’ জানতে চাই, ‘এখন তোমার মা কোথায়, অটাম? তোমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি?’ বিষণ্ন হেসে সে বলে, ‘না, যোগাযোগ নেই, তাকে খুঁজে বের করার জন্য নিকারাগুয়ায় আসা…বাট শি ইজ গন বিফোর আই অ্যারাইভড হিয়ার।’ সে চুপচাপ কাকাওয়ের মগে চুমুক দিয়ে জুড়িয়ে আসা তলানিটুকু পান করে। আমি চুপচাপ প্রতীক্ষা করি। ঠোঁটে নার্ভাস হাসি ফুটিয়ে সে ফের কথা বলে, ‘আলাবামার যে ছোট্ট শহরে আমাদের বাড়ি, ওখানে এসেছিল সিরকা ইতালিয়া নামে ইউরোপের একটি সার্কাস দল। মা ওই সার্কাস দলে মোটরসাইকেলের ট্রিক দেখানো লোকটির প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে ইলোপ হয়ে যায়।’ আমি ফলোআপ প্রশ্ন করি, ‘এখন তোমার মা কোথায়, অটাম?’ সে থুতনিতে তর্জনী রেখে আমার দিকে খানিক ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থেকে জবাব দেয়, ‘মা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে না, আমি তার টেলিফোন নম্বরও জানি না। তার পরও নানা কৌশলে আমি তার সন্ধান পেয়েছি, সে বর্তমানে সিরকা ইতালিয়ায় টিকিট ক্লার্ক হিসেবে কাজ করছে। এই সার্কাস দল পাশের দেশ কোস্টারিকায় শো করছে জানতে পেরে আমি প্রথমে কোস্টারিকায় যাই। ওখানে পৌঁছে শুনি, সার্কাস দলটি নিকারাগুয়ার লেওন শহরে শো করছে। তো, আমি তার তালাশে লেওনে এলাম। বাট অ্যালাস, আমার ভাগ্য আসলেই খারাপ, সার্কাস দলটি নিকারাগুয়া ছেড়ে শো করতে চলে গেছে আর্জেন্টিনায়, নাউ আই ডোন্ট হ্যাভ দ্য মানি টু ফ্লাই অল দ্য ওয়ে টু আর্জেন্টিনা।’

পুরো কাহিনিটি শুনে আমি প্রতিক্রিয়ায় কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকি। অটাম সেলফোন হাতে নিয়ে কী একটি স্ক্রল করছে। বুঝতে পারি, লেওন ভিয়েখো এলাকা মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত। তার টেলিফোনে ‘বিং’ করে আওয়াজ হলে সে টেক্সটটি পড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘স্যরি, মাই বয়ফ্রেন্ড ইজ নকিং, আমাকে উঠতে হয়।’ আমি তাকে ‘আদিওস’ বা ‘গুডবাই’ বলি। সে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ফিরে আমার হাতে লাকি চার্মটি ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘ডু ইউ মাইন্ড…আমি যদি তোমাকে এটি পরিয়ে দেওয়ার রিকোয়েস্ট করি।’ আমি তার কবজিতে বিডের চার্মটি জড়াতে জড়াতে বলি, ‘আই অ্যাম ডিলাইটেড অ্যান্ড দিস ইজ ইনডিড মাই প্লেজার।’ অটামের চোখে-মুখে ফিরে এসেছে নির্বাসিত রাজকুমারীর বিধুর অভিব্যক্তি। কপালে এসে পড়া একগুচ্ছ চুল সরিয়ে দিয়ে সে কিছু না বলে চলে যায় পুরাতাত্ত্বিক সাইটের আপিসঘরের দিকে।

আমি রেস্তোরাঁর কাঠের ডেকে বসে আরেক পেয়ালা কাকাও পান করি। বেলা পড়ে এসে রোদের তেজ মোলায়েম হয়ে উঠছে। বিল পে করতে গিয়ে ফ্যালাচি দম্পতির তালাশে এদিক-ওদিক তাকাই, মনে হয় তাঁরাও উঠে পড়েছেন। লেক মানাগুয়ার পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি সরোবরের নিরিবিলি কিনারে। এখানে সাক্ষাৎ পাওয়া যায় অধ্যাপক দম্পতি ফ্যালাচিদের। হ্যাটের সঙ্গে লারেলাপ্পা শার্ট পরা টমাস এবং কাঁধে বিরাট একটি পার্স ঝোলানো হাসিমুখ শ্যারোলের দিকে তাকিয়ে বোঝার কোনো কুদরত নেই এঁরা ভুগছেন বার্ধক্যজনিত রোগশোকে। আমি দাঁড়িয়ে পড়ে জানতে চাই, ‘হাউ আর ইউ গাইজ ডুয়িং?’ শ্যারোল শোল্ডার শ্রাগ করে খোশমেজাজি হাসিতে ভরিয়ে তোলেন তাঁর মুখ। টমাস কাঁধে ঝোলানো ভারী ক্যামেরার ফিতাটি অ্যাডজাস্ট করতে করতে জবাব দেন, ‘এখন শরীরে ট্রাভেলিংয়ের ধকল আমরা আর নিতে পারি না। দেশের বাইরে এলেই একটা না একটা অসুখবিসুখ মাথাচাড়া দেয়।’ শুনে আমি মন্তব্য করি, ‘না হয়, আগামী দু-এক বছর ট্রাভেল না করে ঘরে বসে একটু রেস্ট নেন।’ ম্লান হেসে টমাস বলেন, ‘লাতিন আমেরিকার কয়েকটি ধ্বংসস্তূপের ওপর বেশ কতকগুলো রিসার্চ আর্টিকল লিখব বলে অনেক দিন ধরে ভাবছি। শ্যারোলও শেষ করতে চায় মৃৎপাত্রের গায়ে আঁকা চিত্রগুলোর ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে তৈরি পুরো একটি বই। সো, আই গেস…হোয়াট টু ডু…উই ডু হ্যাভ টু ট্রাভেল আ বিট।’ আমি তাঁদের ‘গুডলাক’ বলে আগ বাড়ি।

আরো খানিক হেঁটে আসতেই দেখি, সরোবরের কিনারজুড়ে ফুটে আছে নানা বর্ণের অজস্র সন্ধ্যামালতি। এই ফুলগুলো নিকারাগুয়ায় ‘মিরাবিলিস জালাপা’ নামে পরিচিত। এদের বিকেলে ফুটে ওঠা থেকে অনুমান করি, বিকেল এখন ৫টার মতো। ঢোলকের মৃদু আওয়াজে ঘাড় বাঁকাতেই চোখে পড়ে, বেশ খানিকটা দূরে—যেখানে সরোবরটির কিনারা বেঁকে গেছে সারসের গ্রীবার মতো, ওখানে ড্রামে চাটি মারতে মারতে এসে দাঁড়িয়েছে চারজন আদিবাসী মানুষ। এদের দুজনের হাতে কাটা বাঁশের টুকরার মতো কাপড়ের ন্যাতাকিনি পেঁচানো বিচিত্র কোনো বাদ্যযন্ত্র। আমি ক্যামেরার টেলিলেন্স দিয়ে দূর থেকে তাদের দিকে তাকাই। মনে হয়, বাদ্য-বাজনার তালে তালে তারা আগুনপাহাড় মমোতমবোর উদ্দেশে জানাচ্ছে তাদের অন্তরের আকুতি।

পুরাতাত্ত্বিক সাইটের পর্যটনি আপিসের দিকে ফেরার পথে কেবলই মনে হতে থাকে, নিকারাগুয়ায় আমার কেটে তো গেল বেশ কিছু দিন, হরেক রকমের মানুষের সঙ্গে আমার বিস্তর মিথস্ক্রিয়া হলো; কিন্তু আদিবাসী মানুষের দিনযাপন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা হলো না। ভাবতে ভাবতে এক ধরনের অতৃপ্তির সঙ্গে মিশে যেতে থাকে এই অসম্পূর্ণ সফর সম্পর্কে আমার নিজস্ব প্রতিফলন।

 
সূত্র
কালের কণ্ঠ

অনলাইন ডেস্ক

সংবাদটি এবং সংযুক্ত মিডিয়া (ছবি-ভিডিও-গ্রাফ) বিভিন্ন দেশীয় অথবা আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা হতে সংগ্রহীত অথবা অনুবাদকৃত। এর কোন কৃতিত্ব অথবা কপিরাইট আমাদের নয়।

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Back to top button